আপনার হার্ট ঠিক আছে তো? জেনে রাখুন ।

26/12/2010 00:39

ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ শুধু উন্নত বিশ্ব নয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও হার্টের রোগী এত বাড়বে যে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের হার্টের সমস্যা থাকবে।

বর্তমানে কার্ডিওভাস্কুলার বা হার্টের সমস্যা বেশি হওয়ার কারণগুলোর অন্যতম হলো
- খাদ্যাভ্যাস
- কায়িক শ্রমের অভাব
- টেনশন বা দুশ্চিন্তা
- মেয়েদের বেশি বয়সে বিয়ে করা ও বাচ্চা নেওয়া
- ধূমপান
- ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ
- জেনেটিক বা বংশগত।


আশার কথা হলো, একমাত্র জেনেটিক বা বংশগত কারণ ছাড়া বাকি সবগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বা পরিবর্তন করে হার্টকে সুস্থ রাখা সম্ভব।

 

হার্টের অসুখগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
-    করোনারি বা হার্টে রক্ত সরবরাহকারী ধমনিতে ব্লক বা চিকন হয়ে যাওয়ার কারণে উদ্ভূত সমস্যাগুলো, যেমন_মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, আনস্টেবল এনজিনা, স্টেবল এনজিনা, হার্ট ব্লক, অ্যরিদমিয়া ইত্যাদি।
-    হার্টের ভাল্বের (চারটি ভাল্ব রয়েছে) সমস্যা যেমন_মাইট্রাল স্টেনোসিস, অ্যায়োর্টিক স্টেনোসিস, মাইট্রাল রিগারজিটেশন, পালমোনারি স্টেনাসিস ইত্যাদি।
-    জন্মগত ত্রুটি। যেমন_পর্দায় ফুটো (অঝউ বা ঠঝউ) টেট্রালজি অব ফ্যাল্ট (ঞঙঋ), পিডিএ ইত্যাদি।
হার্ট ভালো রাখার উপায়গুলো তাই এই তিন আঙ্গিকে বিবেচনা করতে হবে। হার্ট ভালো রাখার উপায় বলতে আমরা সাধারণত হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ব্লক ইত্যাদি থেকে মুক্তি পাওয়াকেই বুঝি।

 

 

যাদের হার্টে এখনো কোনো সমস্যা নেই এবং অন্য কোনো অসুখও নেই।
যাদের হার্টে কোনোরূপ সমস্যা নেই ও ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা কিডনির সমস্যাও নেই তাদের জন্য হার্ট বিশেষজ্ঞরা হার্ট ভালো রাখতে কয়েকটি পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আমেরিকার হার্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকেও বলা হয়েছে এ উপায়গুলোর কথা।


চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া কমানো

-কিছু পরিমাণ চর্বি আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন, কিন্তু চর্বি বেশি খেলে সেই অতিরিক্ত চর্বি হার্টের -ধমনির গায়ে জমা হতে হতে তৈরি করতে পারে গুরুতর সমস্যা। স্যাচুরেটেড ফ্যাট সংবলিত খাবার; -যেমন_মাংসের চর্বি, বার্গার, মাখন, কুকি, কেক ইত্যাদি বেশি খাওয়া অত্যন্ত ক্ষতিকর। অন্যদিকে -পলিআনস্যাটুরেটেড ফ্যাটি এসিড সংবলিত খাবার রক্তের কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। বাদাম, মাছের -তেল, সামুদ্রিক মাছ, সূর্যমুখী তেল ইত্যাদি এজন্য ভালো। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে -সপ্তাহে অন্তত ১০০ গ্রাম বাদাম খাওয়া উচিত।


খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন

--ব্যস্তজীবনের কর্মতৎপরতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফাস্ট লাইফের সঙ্গে বাড়ছে ফাস্ট ফুড খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ। কিন্তু এ খাবারগুলো মুখরোচক হলেও হার্টের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। মাঝেমধ্যে খাওয়া -যাবে কিন্তু প্রতিদিন খাওয়া চলবে না। এর পরিবর্তে দৈনিক খাদ্য তালিকায় শাকসবজি, ফাইবারযুক্ত খাবার ও অন্তত একটি ফল রাখতে হবে।
-ধূমপান পরিত্যাগ
-হার্ট অ্যাটাকের ৫০ শতাংশ ব্যক্তিই ধূমপায়ী। ধূমপান অ্যাথেরোসক্লোরোসিসকে সরাসরি প্রভাবিত করে ও ধমনিগুলোকে শক্ত করে দেয়। ধূমপান পরিহার করার সঙ্গে সঙ্গে পান, জর্দা, তামাক ইত্যাদিও কমিয়ে দিন।


ব্যায়াম করুন
-মানুষের শারীরিক শ্রম ও চলাফেরা অনেক কমিয়ে দিয়েছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার। এখন প্রায় সব কাজই টেবিল-চেয়ারে বসে সম্পন্ন করতে হয়। কারো সঙ্গে দেখা করতে না গিয়ে মোবাইল ফোনে বা মেইল করে কাজ সেরে ফেলি, অল্প দূরত্বে যেতে হলেও গাড়ি ব্যবহার করি। ফলে চর্বি সঞ্চিত হতে থাকে, যা করোনারি ধমনিতে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস করে। অতএব দৈনিক অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করতে হবে, লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে, অল্প দূরত্বে হেঁটে যেতে হবে ও শিশুদের কম্পিউটার গেমসের পরিবর্তে খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে হবে।


টেনশন কমান
উন্নত জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে টেনশন বা দুশ্চিন্তা। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হার্টের সমস্যা। জীবনকে পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা শুরু করতে হবে, দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকতে হবে। অবসর সময়ে বই পড়া, বাগান করা, গান শোনা ও সমাজের কল্যাণকর কোনো কাজে ভূমিকা রাখা ইত্যাদি করা যেতে পারে।


বিশ্রাম নিতে হবে
কাজের ফাঁকে পাঁচ-দশ মিনিট বিশ্রাম নিতে হবে। দৈনিক সাত-আট ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। সুন্দর দাম্পত্য জীবন বজায় রাখতে হবে। পরিবারের সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।


সতর্ক থাকুন
যাদের এখনো হার্টের সমস্যা নেই কিন্তু বংশে অল্প বয়সে (৪০-এর নিচে) হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ইতিহাস আছে তাদের সতর্ক থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই কোনো লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই তাদের হার্টের অসুখ দেখা দিতে পারে।

যাদের হার্টের সমস্যা আছে এবং শারীরিক অন্য সমস্যাও রয়েছে
-    উচ্চ রক্তচাপ থাকলে হার্টকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়, ফলে হার্ট ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। একসময় বড় হওয়া সত্ত্বেও শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত পাম্প করতে না পারায় হার্ট ফেইলিওরে (হার্টের রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে হার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া) চলে যায়। অতএব, যাদের উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়েছে তাদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে।
-    ডায়াবেটিসকে বর্তমানে হার্টের সমস্যার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অতএব যাদের ডায়াবেটিস রোগ ধরা পড়েছে তাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তনে ওষুধ বা প্রয়োজনে ইনসুলিন নেওয়ার মাধ্যমে ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।


উচ্চ রক্তচাপের ডায়াবেটিক ও হার্টের সমস্যার রোগীরা যা খেতে পারবেন না।
_খাসির মাংস ও চর্বিযুক্ত গরুর মাংস
_মগজ, কলিজা ও ডিমের কুসুম
_চিংড়ি মাছের মাথা
_নারিকেল
_মাখন, ঘি, দুধের সর
_কেক, পেস্টি, সেমাই, পায়েস।
-    ধূমপান কার্বন-মনোঙ্াইড তৈরি করে হিমোগ্লোবিনের অঙ্েিজন সংবহন কমিয়ে দেয়। ফলে হার্টের অঙ্েিজনের অভাব দেখা দেয়। যাদের এরই মধ্যে হার্টের ধমনিগুলো সরু হতে শুরু করেছে তাদের ক্ষেত্রে ধূমপান হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিওর এমনকি আকস্মিক কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট পর্যন্ত হতে পারে।


ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
-    দৈনিক নিয়ম করে দুই বেলা ৩০-৪০ মিনিট হাঁটতে হবে। প্রথমে আস্তে হাঁটা শুরু করে ধীরে ধীরে হাঁটার গতি বাড়াতে হবে। তবে বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি হলে বা মাথা ঘুরলে, অতিরিক্ত ঘাম হলে তৎক্ষণাৎ হাঁটা বন্ধ করে বিশ্রাম নিতে হবে।
-    ঘুমের অভাবে রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস বাড়ে, ঘুমাতে হবে আট-দশ ঘণ্টা।
-    চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে হবে; যেমন_ইসিজি, ইটিটি বা ইকোকার্ডিওগ্রাম করে জেনে নিতে হবে হার্ট কতটুকু ভালো আছে।

 

 

যাদের এনজিওপ্লাস্টি, পিসিআই বা বাইপাস সার্জারি হয়েছে
অ্যাথেরোসক্লেরোসিস একটি চলমান প্রক্রিয়া। কাজেই যাদের হার্টে স্টেন্ট বসানো হয় বা বাইপাস করা হয়, তারা চিরদিনের জন্য একটি সুস্থ হার্ট পেয়ে গেছেন_এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং আজীবন তাদের নিয়ম মেনে চলতে হবে।
-    চর্বিজাতীয় খাবার বর্জন করতে হবে।
-    ধূমপান করা যাবে না।
-    রক্ত তরলীকরণের ওষুধ যেমন অ্যাসপিরিন ও কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ যেমন অ্যাটোভাস্টাটিন নিয়মিত সেবন করতে হবে
-    দৈনিক ৪০ মিনিট হাঁটতেই হবে।
-    চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করার চেষ্টা করতে হবে।

ভাল্বের সমস্যা সাধারণত জন্মগত ও রিউমেটিক ফিভার বা বাতজ্বরের কারণে দেখা যায়। বাংলাদেশে ভাল্বের সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় মাইট্রাল স্টেনোসিস। ৯৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই এর কারণ বাতজ্বর। অথচ এ বাতজ্বরজনিত হার্টের সমস্যার প্রতিরোধ করা যায়।
শিশুর ঘন ঘন জ্বর হলে, গিঁটে ব্যথা হলে, গিরা ফুলে গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বাতজ্বর ধরা পড়লে পূর্ণ চিকিৎসা করাতে হবে।
মনে রাখতে হবে, বাতজ্বরের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হলেও দেশের সবখানে এর চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এবং তা খুবই সস্তা। কিন্তু ভাল্ব নষ্ট হয়ে গেলে যে কৃত্রিম ভাল্ব সংযোজন করা হয়, তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

হার্টের জন্মগত ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে হলে
-    মহিলাদের বেশি বয়সে সন্তান ধারণ করা যাবে না।
-    নিকটাত্মীয়, যেমন_আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে এড়িয়ে -লতে হবে।
-    গর্ভবতী অবস্থায় ডায়াবেটিস ধরা পড়লে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
-    গর্ভবতী অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোনোরূপ ওষুধ খাওয়া যাবে না।
-    রুবেলা ইনফেকশনে বাচ্চার জন্মগত হার্টের ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর টিকা রয়েছে। তাই প্রত্যেক মাকে এ টিকা নিয়ে নিতে হবে।
-    সন্তান ধারণের আগেই এইডস, গনোরিয়া, সিফিলিস ইত্যাদি আছে কি না, তা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে।
-    আগে অ্যাবরশন বা বারবার বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ইতিহাস থাকলে চিকিৎসককে জানাতে হবে।

ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদ
সহযোগী অধ্যাপক
হৃদরোগ বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্রঃ- এখানে